রিপোর্টঃ ইনভেস্টিগেটিভ করেসপন্ডেন্ট (নরসিংদী)
নরসিংদীর রাজনীতিতে সম্প্রতি সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু হয়ে উঠেছে বেলাবোর স্বতন্ত্র সংসদীয় আসনের দাবি। বেলাবোবাসী দীর্ঘদিন ধরে আলাদা আসনের দাবি জানালেও এবার বিষয়টি নতুন মোড় নিয়েছে রায়পুরার চারটি ইউনিয়ন—রাধানগর, উত্তর বাখানগর, মুছাপুর ও মরজাল—বেলাবোর সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাবকে ঘিরে। এতে যেমন বেলাবোবাসী আন্দোলনে নেমেছেন, তেমনি রায়পুরাবাসী ক্ষোভ ও প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও এই ইস্যুতে সরাসরি অবস্থান নিচ্ছেন, যা নরসিংদীর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন বিতর্ক তৈরি করেছে।
দীপ্ত শপথে লড়বো, বেলাবকে স্বতন্ত্র সংসদীয় আসনে গড়বো” এই স্লোগানকে সামনে রেখে নরসিংদীর বেলাব উপজেলাকে আলাদা সংসদীয় আসন করার দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বেলাব উপজেলার সর্বস্তরের জনগণ।
শনিবার (২৩ আগষ্ট ) বিকালে উপজেলার বেলাব বাজার শাপলা চত্বরে “স্বতন্ত্র সংসদীয় আসন বাস্তবায়ন পরিষদ” এর ব্যানারে উক্ত মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন” স্বতন্ত্র সংসদীয় আসন বাস্তবায়ন পরিষদের সদস্য সচিব মোঃ ইসলাম উদ্দিন, উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দীন ভূইয়া, বেলাব সদর ইউনিয়ন বিএনপি সাবেক সভাপতি এ কে এম আক্তারুজ্জামান, বেলাব প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোঃ আমিনুল হক, চলো গড়ি বেলাব এডমিন প্যানেলের সদস্যবৃন্দ’সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
এসময় বক্তারা বলেন, বেলাব উপজেলা নরসিংদী জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ইউনিট। জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বেলাব উপজেলা স্বতন্ত্র সংসদীয় আসন হওয়ার যোগ্যতা রাখে। বর্তমানে বেলাব নরসিংদী-৪ (বেলাব- মনোহরদী) আসনের অংশ হলেও, স্বতন্ত্র আসনের দাবী উপজেলার সর্বস্তরের জনগণের।
দীর্ঘদিন ধরে নরসিংদী-৪ আসনটি মনোহরদী-বেলাবো নিয়ে গঠিত। তবে বেলাবোবাসীর দাবি, তাদের জনসংখ্যা, ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও শিক্ষাবান্ধব পরিবেশের কারণে স্বতন্ত্র সংসদীয় আসন থাকা উচিত। ২০২৫ সালের ২৩ আগস্ট বেলাব বাজারের শাপলা চত্বরে “স্বতন্ত্র সংসদীয় আসন বাস্তবায়ন পরিষদ” এর উদ্যোগে বিশাল মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। বক্তারা উল্লেখ করেন, স্বাধীন প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর মাধ্যমে বেলাবোর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আরও সুসংগঠিত হবে এবং দীর্ঘদিনের বঞ্চনা থেকে মুক্তি মিলবে। এর আগে ১১ আগস্ট একটি প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদনপত্র জমা দিয়ে আলাদা আসনের দাবি জানায়।
তবে এই প্রস্তাবে রায়পুরার চারটি ইউনিয়নকে বেলাবোর সঙ্গে যুক্ত করার বিষয়টি নতুন দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছে। রায়পুরার মানুষ মনে করছেন, ঐতিহ্যবাহী ও প্রভাবশালী ইউনিয়নগুলোকে বিচ্ছিন্ন করা মানে তাদের রাজনৈতিক অধিকার ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য খর্ব করা। ২৮ আগস্ট রায়পুরায় ব্যাপক বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, শুধুমাত্র রাজনৈতিক সুবিধা কিংবা বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থে যদি এই পরিবর্তন আনা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের বিভেদ তৈরি হবে। বিশেষ করে ইলিয়াস উদ্দীনের প্রস্তাব সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়লে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়।
বেলাবোর দাবি সমর্থনে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দীন ভূঁইয়া, জেলা বিএনপির নেতারা এবং “চলো গড়ি বেলাব” ফেসবুক গ্রুপের সংগঠকরা যৌথভাবে দাবি জোরালো করছেন। এদিকে আদালতের বাইরে মানববন্ধন আয়োজনসহ নানা কর্মসূচি আন্দোলনকে গতিশীল করে তুলছে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ও বর্তমান শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন আসন পুনর্বিন্যাস প্রসঙ্গে সরাসরি মন্তব্য না করলেও স্বতন্ত্র আসনের দাবি আসন্ন নির্বাচনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী সাইফুল ইসলাম খান বীরুও এ ইস্যুকে রাজনৈতিক পুঁজি হিসেবে কাজে লাগাচ্ছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বেলাবোবাসীর যুক্তি যে তারা উন্নয়নের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন অবহেলিত—তা উপেক্ষা করার মতো নয়। তবে রায়পুরাবাসীর ক্ষোভও যথার্থ, কারণ ঐতিহ্যবাহী ইউনিয়নগুলোকে বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত তাদের রাজনৈতিক অধিকার খর্ব করতে পারে। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের ভারসাম্যপূর্ণ ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় পর্যায়ে গণশুনানি আয়োজন, জনগণের মতামত নেওয়া এবং স্বচ্ছ আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিলে দ্বন্দ্ব প্রশমিত হতে পারে। অন্যথায়, এই ইস্যু নরসিংদীর রাজনীতিকে আরও বিভাজিত করে ভবিষ্যতের নির্বাচনী রাজনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।