রিপোর্টঃ আবদুল্লাহ আল মামুন, নির্বাহী সম্পাদক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের ভোটগণনা প্রায় সমাপ্তির পথে। প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, ভাইস-প্রেসিডেন্ট (ভিপি) পদে আবু সাদিক কায়েম এবং সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে এস এম ফরহাদ বিপুল ব্যবধানে জয়লাভের পথে রয়েছেন। তবে শুধুমাত্র ভোটের সংখ্যাই নয়, পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়া, ভোটকেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা, প্রতিদ্বন্দ্বী প্যানেলগুলোর অভিযোগ এবং ছাত্রসমাজের প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করলে এই নির্বাচনকে বিস্তারিত এবং বিতর্কিত উভয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা যায়।
ভোটকেন্দ্র এবং ভোটার পরিস্থিতি
২০২৫ সালের ডাকসু নির্বাচনে মোট ৮টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়, যা শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুবিধার্থে ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্থাপন করা হয়েছিল। কেন্দ্রগুলো হলোঃ কার্জন হল, শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র, টিএসসি, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ইউনিভার্সিটি ল্যাব স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সিনেট ভবন, উদয়ন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব।
এই নির্বাচনে প্রায় ৬৫৮ জন শিক্ষার্থী মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছিলেন, যার মধ্যে ১০৬ জন চূড়ান্তভাবে মনোনয়ন জমা দেন। ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন হয়। প্রতিটি কেন্দ্রেই শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত এবং উৎসবমুখর অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা গেছে।

ভাইস-প্রেসিডেন্ট (ভিপি) পদঃ
-
সাদিক কায়েম (শিবির সমর্থিত): ৭,৫১৬ ভোট
-
আবিদুল ইসলাম (ছাত্রদল সমর্থিত): ৩,৬৫৩ ভোট
-
উমামা ফাতেমা: ২,৩৫৫ ভোট
-
শামীম হোসেন: ২,৪০৯ ভোট
সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদঃ
-
এস এম ফরহাদ (শিবির সমর্থিত): ৫,৬৩৮ ভোট
-
মেঘমল্লার বসু: ৩,৪৬৫ ভোট
-
তানভীর বারী হামিম: ২,৭৫৩ ভোট
প্রত্যেক কেন্দ্রে সাদিক ও ফরহাদ নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় উল্লেখযোগ্য ব্যবধানে এগিয়ে আছেন। উদাহরণস্বরূপ, রোকেয়া হলে ভিপি পদে সাদিক পেয়েছেন ১,৪৭২ ভোট এবং জিএস পদে ফরহাদ পেয়েছেন ১,১২০ ভোট। শেখ ফাজিলাতুন্নেছা মুজিব হল এবং কুয়েত মৈত্রী হল থেকেও তাদের প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
নির্বাচনী প্যানেল এবং রাজনৈতিক প্রভাব
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু নির্বাচনে প্রার্থীরা প্রধানত তিনটি বৃহৎ প্যানেলের ব্যানারে অংশগ্রহণ করেন:
ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল: সাদিক কায়েম (ভিপি), এস এম ফরহাদ (জিএস)
-
ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল: আবিদুল ইসলাম (ভিপি)
-
স্বতন্ত্র ও প্রগতিশীল জোট: বিভিন্ন কেন্দ্রের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও প্রগতিশীল জোট
নির্বাচন শুধুমাত্র ডাকসুর নেতৃত্ব নির্ধারণে নয়, এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকেও প্রতিফলিত করে। শিবির সমর্থিত প্রার্থীরা বিজয়ী হলে বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতিতে তাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে। অন্যদিকে, ছাত্রদল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোট দেখায় রাজনৈতিক বহুত্ববাদ এখনও বিদ্যমান।
নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হলেও কিছু বিতর্ক এবং অভিযোগ এর স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
-
‘প্রহসন পর্ষদ’-এর প্রার্থী তাসনিম আফরোজ ইমি অভিযোগ করেছেন, ক্যাম্পাসে একটি "যুদ্ধংদেহী" পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে এবং গণতান্ত্রিকভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগে বাধা দেওয়া হয়েছে।
-
কিছু কেন্দ্রে ভোট গণনায় বিলম্ব এবং স্বচ্ছতার অভাবের অভিযোগ ওঠেছে।
-
ছাত্রদল সমর্থিত ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম কিছু কেন্দ্রে ফলাফলকে "পরিকল্পিত প্রহসন" বলে আখ্যায়িত করেছেন।
তবে প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন জানিয়েছেন, ভোট গণনা যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়েছে এবং চূড়ান্ত ফলাফল শিগগিরই ঘোষণা করা হবে।
নির্বাচনের দিন ভোর থেকেই সিনেট ভবনের সামনে শিক্ষার্থীদের বিপুল উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। শিক্ষার্থীরা ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক অভিমত প্রকাশ করেছেন। সার্বিকভাবে, ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া উত্তেজনাপূর্ণ হলেও শান্তিপূর্ণ ছিল।
বিশ্লেষণ ও সম্ভাব্য প্রভাবঃ
-
শিবিরের প্রার্থীদের বিপুল বিজয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতিতে তাদের প্রভাব এবং নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করবে।
-
ছাত্রদল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোট প্রমাণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক অঙ্গন এখনও বহুত্ববাদী।
-
নির্বাচন-পরবর্তী বিতর্ক এবং অভিযোগ যথাযথভাবে মোকাবিলা করলে শিক্ষার্থীদের আস্থা পুনরুদ্ধার সম্ভব।
-
ভবিষ্যতে ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ, প্রার্থীদের মনস্তত্ত্ব এবং ভোট গণনার স্বচ্ছতা নিয়ে আরও বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন অপরিহার্য।
২০২৫ সালের ডাকসু নির্বাচন প্রমাণ করে, শিক্ষার্থীরা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগে সচেষ্ট ও সচেতন। প্রাথমিক ফলাফলে সাদিক কায়েম ও এস এম ফরহাদ বিজয়ী অবস্থায় থাকার ইঙ্গিত দিয়েছে, যা শিবির সমর্থিত প্যানেলের প্রভাব প্রদর্শন করে। তবে, বিতর্ক এবং অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সতর্ক করবে। নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল এবং এর পরবর্তী পরিস্থিতি নির্ধারণ করবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ কোন দিকে মোড় নেবে।