বঙ্গাব্দ Christ

কোরআন ও হাদিসের আলোকে সত্য ঘটনা: মানব জীবনের প্রেরণা ও শিক্ষা - পর্ব ০১

  • নিউজ প্রকাশের তারিখ : Jun 11, 2025 ইং
কোরআন ও হাদিসের আলোকে সত্য ঘটনা ছবির ক্যাপশন: কোরআন ও হাদিসের আলোকে সত্য ঘটনা
ad728

১. গুহায় আটকে পড়া তিন ব্যক্তির ইবাদতের ফসল

একবার তিনজন ব্যক্তি বিপদ থেকে বাঁচতে একটি গুহায় আশ্রয় নেন। হঠাৎ পাহাড় থেকে গড়িয়ে আসা এক বিশাল পাথর গুহার মুখ বন্ধ করে দেয়, তাদের বের হওয়ার সব পথ বন্ধ করে দেয়। যখন তারা নিজেদের অসহায় দেখতে পেলেন, তখন তারা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, নিজেদের জীবনে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা সবচেয়ে নেক আমলগুলোর কথা স্মরণ করে আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন। প্রথম ব্যক্তি তার পিতামাতার প্রতি চরম ভক্তির কথা বললেন, যে তিনি রাতের বেলায় তাদের দুধ পান না করিয়ে নিজের পরিবারকে খাওয়াতেন না এবং ঘুমিয়ে থাকা পিতামাতার জন্য সারারাত দুধের পাত্র হাতে দাঁড়িয়েছিলেন। দ্বিতীয় ব্যক্তি এক মহিলাকে খারাপ কাজে লিপ্ত হওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করার সুযোগ পেয়েও শুধুমাত্র আল্লাহর ভয়ে সেই কাজ থেকে বিরত থাকার কথা বললেন। তৃতীয় ব্যক্তি তার একজন শ্রমিকের পাওনা টাকা দিয়ে ব্যবসা করে তা দ্বিগুণ করার পর, সেই শ্রমিক ফিরে এলে তার সকল লাভ তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বললেন। তাদের প্রত্যেকের এই নিবেদিত আমলের দোয়ার বরকতে পাথরটি সরতে থাকে এবং অবশেষে তারা গুহা থেকে মুক্তি পান। এটি প্রমাণ করে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা সৎকর্ম বিপদ থেকে মুক্তির অন্যতম চাবিকাঠি।

হাদিস রেফারেন্স: সহীহ বুখারী, হাদিস নং ২৩৩৩; সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ২৭৪৩।


২. শয়তানের কাছ থেকে আয়াতুল কুরসীর ফজিলত শিক্ষা

এক রাতে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) দেখতে পেলেন এক চোর সদকার মাল চুরি করছে। তিনি তাকে ধরে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে নিয়ে যেতে চাইলেন। চোর নিজের চরম অভাবের কথা বলে ক্ষমা চাইলে আবু হুরায়রা (রা.) তাকে ছেড়ে দেন। পরের দু'দিনও একই ঘটনা ঘটে এবং চোর মিথ্যা বলে পার পেয়ে যায়। তৃতীয় দিন যখন আবু হুরায়রা (রা.) তাকে ধরলেন এবং রাসূল (সা.)-এর কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন, তখন চোর উপায়ন্তর না দেখে বলল, "আমাকে ছেড়ে দিলে আমি তোমাকে এমন কিছু শিখিয়ে দেব, যার মাধ্যমে আল্লাহ তোমাকে কল্যাণ দান করবেন।" সে বলল, "যখন ঘুমাতে যাবে, তখন আয়াতুল কুরসী পাঠ করে ঘুমাবে। তাহলে আল্লাহ তোমার জন্য একজন পাহারাদার নিযুক্ত করবেন এবং কোনো শয়তান সকাল পর্যন্ত তোমার কাছে আসতে পারবে না।" আবু হুরায়রা (রা.) তাকে ছেড়ে দিলেন। সকালে রাসূলুল্লাহ (সা.) এই ঘটনা শুনে বললেন, "যদিও সে চরম মিথ্যাবাদী ছিল, কিন্তু সে সত্য কথা বলেছে। আর সে ছিল শয়তান।" এই ঘটনাটি যেমন শয়তানের ধূর্ততা প্রমাণ করে, তেমনি আয়াতুল কুরসীর অসামান্য ফজিলতও তুলে ধরে।

হাদিস রেফারেন্স: সহীহ বুখারী, হাদিস নং ২৩১১।


৩. আব্বাস (রা.)-এর গোপন সম্পদ সম্পর্কে রাসূল (সা.)-এর নির্ভুল জ্ঞান

বদরের যুদ্ধের সময় হযরত আব্বাস (রা.) তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি এবং যুদ্ধবন্দী হয়েছিলেন। মুক্তিপণ নিয়ে আলোচনার সময় তিনি নিজের কাছে কোনো অর্থ না থাকার কথা বলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, "আপনি কি সেই সম্পদ ভুলে গেছেন যা মক্কা থেকে রওয়ানা হওয়ার সময় আপনার স্ত্রী উম্মুল ফযলের কাছে গোপনে রেখে বলেছিলেন, আমি যদি এই যুদ্ধে মারা যাই, তাহলে এই মাল আমার সন্তানদেরকে দিও?" আব্বাস (রা.) বিস্মিত হয়ে বললেন, "আপনি এই কথা কেমন করে জানলেন? আমি যে রাতের অন্ধকারে একান্ত গোপনে সেগুলো আমার স্ত্রীর কাছে দিয়েছিলাম এবং এই ব্যাপারে তৃতীয় কোনো লোক জানতো না!" রাসূল (সা.) বললেন, "আমার রব আমাকে এই ব্যাপারে অবহিত করেছেন।" এই ঘটনা শুনে আব্বাস (রা.) তাৎক্ষণিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করেন, কারণ তিনি বুঝতে পারলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ ছাড়া এমন গোপন তথ্য জানতে পারতেন না। এই ঘটনা নবুওয়াতের সত্যতা ও রাসূলের অলৌকিক জ্ঞানকে তুলে ধরে।

হাদিস রেফারেন্স: ইমাম ইবনে হিশাম কর্তৃক সংকলিত 'আস-সিরাতুন নববিয়্যাহ' (নবীজীর জীবনীগ্রন্থ)-তে এই ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। (উল্লেখ্য, এটি সরাসরি বুখারী বা মুসলিমের হাদিস নম্বর দিয়ে খুঁজে পাওয়া না গেলেও সীরাতের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থসমূহে এটি একটি সুপরিচিত ঘটনা।)


৪. দুই সাহাবীর লাঠিতে আলোর ঝলকানি

এটি তাবুক যুদ্ধের পরের ঘটনা। একবার হযরত উসায়দ ইবন হুদাইর (রা.) এবং হযরত আব্বাদ ইবন বিশর (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাতের অন্ধকারে বাড়ির দিকে ফিরছিলেন। সেই রাত ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন ও বৃষ্টিমুখর, এবং তাদের সাথে কোনো আলো বা মশাল ছিল না। হঠাৎ তাঁদের একজনের হাতের লাঠিটি আলোকিত হয়ে উঠল, ঠিক যেন একটি প্রদীপের মতো। সেই আলোতে তাঁরা পথ চলতে লাগলেন। যখন তাঁরা কিছুদূর গিয়ে দু'জন দুই দিকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন সেই লাঠিটিও দু'ভাগ হয়ে গেল, এবং প্রত্যেকের হাতের লাঠিই একটি করে আলোকিত প্রদীপের মতো হয়ে উঠল! এই আলোতে তাঁরা নির্বিঘ্নে নিজেদের বাড়িতে পৌঁছালেন।

এই ঘটনাটি স্পষ্টতই আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁদের জন্য একটি অলৌকিক সাহায্য ছিল, যা অন্ধকারে তাঁদের পথ দেখিয়েছিল। এটি সাহাবীদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ এবং তাঁদের ঈমানের দৃঢ়তার এক জ্বলন্ত প্রমাণ। একই সাথে, এটি আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আল্লাহ তাঁর নেক বান্দাদেরকে কিভাবে অভাবনীয় উপায়ে সাহায্য করেন।

হাদিস রেফারেন্স: সহীহ বুখারী, কিতাবুত তাফসীর (সূরা আল-কাহফ), হাদিস নং ৪৯১৯; সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ফাদাইলুস সাহাবা, হাদিস নং ২৪৮৯।


৫. নীল নদের প্রতি উমার (রা.)-এর চিঠি এবং অলৌকিক প্রবাহ

ইসলামী ইতিহাসে বর্ণিত আছে, হযরত উমার (রা.)-এর খেলাফতকালে মিশর বিজয়ের পর সেখানকার অধিবাসীরা নীল নদের কাছে একটি প্রাচীন শিরকপূর্ণ প্রথার কথা জানায়, যেখানে প্রতি বছর একটি কুমারী মেয়েকে নীল নদে উৎসর্গ না করলে নদ শুকিয়ে যেত। হযরত আমর ইবনুল আস (রা.), যিনি তখন মিশরের প্রশাসক ছিলেন, এই প্রথা বাতিল করে দিলেন। এর ফলে নীল নদ শুকিয়ে যেতে লাগল। তিনি বিষয়টি উমার (রা.)-কে জানালে তিনি নীল নদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখে পাঠালেন। চিঠিতে লেখা ছিল: "হে নীল নদ! যদি তুমি নিজের ইচ্ছায় প্রবাহিত হও, তাহলে প্রবাহিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। আর যদি আল্লাহ তোমাকে প্রবাহিত করেন, তাহলে আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি যেন তিনি তোমাকে প্রবাহিত করেন।" আমর ইবনুল আস (রা.) সেই চিঠি নীল নদে নিক্ষেপ করার পর, আল্লাহর রহমতে নীল নদ আবার স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হতে শুরু করে এবং তার পর থেকে আর কখনো শুকায়নি। এই ঘটনা আল্লাহর কুদরত এবং একজন নেক খলিফার মাধ্যমে সৃষ্ট অলৌকিকত্বকে প্রকাশ করে, যা শিরক থেকে বিরত থাকার গুরুত্বও শেখায়।

হাদিস রেফারেন্স: এই ঘটনাটি ইমাম ইবনে কাসীর তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া' (ইসলামী ইতিহাসের বৃহৎ গ্রন্থ)-তে বর্ণনা করেছেন। যদিও এটি সরাসরি সহীহ হাদিস গ্রন্থসমূহে বিস্তারিতভাবে নেই, তবে সীরাত ও ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য কিতাবে এর উল্লেখ পাওয়া যায় এবং ইসলামী পন্ডিতদের মধ্যে এটি সুপরিচিত।


৬. এক অন্ধ সাহাবীর জন্য বৃষ্টির রাতে আলোর ব্যবস্থা

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.) ছিলেন একজন অন্ধ সাহাবী। তিনি একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে অভিযোগ করলেন যে, তার বাড়ি মসজিদ থেকে অনেক দূরে এবং তার কোনো পথপ্রদর্শকও নেই। তিনি জানতে চাইলেন, এমতাবস্থায় তার জন্য কি ঘরে নামায পড়ার অনুমতি আছে? রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, "তুমি কি আযান শুনতে পাও?" তিনি উত্তর দিলেন, "হ্যাঁ।" তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, "তাহলে তুমি নামাযের জন্য মসজিদে আসবে।" এই ঘটনাটি রাসূল (সা.)-এর যুগে সংঘটিত হয়নি, বরং রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন মসজিদে আসতে নিষেধ করেননি, তখন আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় এমন অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল। পরবর্তীতে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.) যখন রাতে বৃষ্টির কারণে বা অন্ধকারের কারণে পথ দেখতে পেতেন না, তখন আল্লাহ তাঁর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতেন। পথ আলোকিত হয়ে যেত, যাতে তিনি সহজেই মসজিদে পৌঁছাতে পারতেন। এটি প্রমাণ করে, আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস এবং ইবাদতে অবিচলতা মানুষকে কিভাবে অলৌকিক সাহায্য পেতে সাহায্য করে।

হাদিস রেফারেন্স: সহীহ মুসলিম, কিতাবুল মাসাজিদ ওয়া মাওয়াদি'ইস সালাত, হাদিস নং ৬৫৩ (তবে এখানে সরাসরি আলোর কথা উল্লেখ না থাকলেও, এটি তাঁর মসজিদে আসার দৃঢ়তা এবং আল্লাহর সাহায্যের একটি উদাহরণ হিসেবে দেখা হয়)। 'কানযুল উম্মাল' এবং কিছু সীরাত গ্রন্থে তার জন্য পথের আলোকিত হওয়ার ঘটনা বর্ণিত আছে।


৭. এক মহিলা সাহাবীর জন্য জান্নাতের সুসংবাদ

হযরত আতা ইবনে আবি রাবাহ (রহ.) বর্ণনা করেন, হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) তাকে বললেন, "আমি কি তোমাকে একজন জান্নাতী মহিলা দেখাব?" আতা বললেন, "হ্যাঁ।" ইবনে আব্বাস (রা.) বললেন, "এই যে কালো মহিলাটি, সে নবী (সা.)-এর কাছে এসে বলেছিল, 'আমি মৃগীরোগে আক্রান্ত হই এবং তখন আমার শরীর অনাবৃত হয়ে যায়। সুতরাং আল্লাহর কাছে আমার জন্য দোয়া করুন।' নবী (সা.) বললেন, 'যদি তুমি ধৈর্য ধারণ করো, তাহলে তোমার জন্য জান্নাত রয়েছে। আর যদি তুমি চাও, তাহলে আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করছি যেন তোমাকে আরোগ্য দেন।' মহিলাটি বলল, 'আমি ধৈর্য ধারণ করব। তবে (আক্রান্ত হলে) আমার শরীর অনাবৃত হয়ে যায়, সুতরাং আল্লাহর কাছে দোয়া করুন যেন আমার শরীর অনাবৃত না হয়।' নবী (সা.) তার জন্য দোয়া করলেন।" এই ঘটনাটি ধৈর্য ধারণের ফজিলত এবং আল্লাহর প্রতি অটল বিশ্বাসের গুরুত্ব তুলে ধরে। একই সাথে রাসূল (সা.)-এর প্রতি সাহাবীদের অগাধ বিশ্বাস এবং তাঁর দোয়ার বরকতের প্রমাণও বহন করে।

হাদিস রেফারেন্স: সহীহ বুখারী, কিতাবুল মারদা ওয়া কাফফারাতুল আমরদি, হাদিস নং ৫৬৫২; সহীহ মুসলিম, কিতাবুল বিররি ওয়াস সিলাতি ওয়াল আদাব, হাদিস নং ২৫৭২।


নিউজটি আপডেট করেছেন : নিউজ ডেস্ক

নিউজ লিঙ্ক কপি করুনঃ
www.dailyeye.site/details/581/কোরআন-ও-হাদিসের-আলোকে-সত্য-ঘটনা:-মানব-জীবনের-প্রেরণা-ও-শিক্ষা---পর্ব-০১/

কমেন্ট বক্স