বঙ্গাব্দ Christ

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ: উপমহাদেশে অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও জীবনযাত্রায় বড় প্রভাবের আশঙ্কা

  • নিউজ প্রকাশের তারিখ : Jun 22, 2025 ইং
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের সম্ভাব্য প্রভাব ছবির ক্যাপশন: ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের সম্ভাব্য প্রভাব
ad728

আবদুল্লাহ আল মামুনঃ
সম্প্রতি ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই এ যুদ্ধের প্রভাব মধ্যপ্রাচ্য ছাড়িয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এই অঞ্চলের তিন প্রধান দেশ—বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান—মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক, শ্রমিক ও জ্বালানি নির্ভরশীলতার সম্পর্কে আবদ্ধ। ফলে এই যুদ্ধ তাদের অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।


জ্বালানি তেলের বাজারে অস্থিরতা ও দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা

ইরান বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহৎ প্রাকৃতিক গ্যাস রিজার্ভ এবং তৃতীয় বৃহৎ অপরিশোধিত তেল রিজার্ভের অধিকারী দেশ। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে হরমুজ প্রণালী বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যেটি বিশ্ব তেল বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ। ইরান ইতোমধ্যেই এই প্রণালী বন্ধের হুমকি দিয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে তেল-গ্যাস পরিবহনে বিকল্প পথ ব্যবহার করতে হবে, যা খরচ অনেক বাড়িয়ে দেবে।

ভারত ও পাকিস্তান সরাসরি ইরান থেকে তেল আমদানি করে। বাংলাদেশ কাতার ও ওমান থেকে এলএনজি আমদানি করে। ফলে তেল ও গ্যাসের দাম বেড়ে গেলে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের পরিবহন, উৎপাদন, বিদ্যুৎ ও নিত্যপণ্যের দামে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। এ কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে এবং সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়বে।


মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে অনিশ্চয়তা

ইরান ও আশপাশের মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের লাখ লাখ মানুষ কর্মরত। শুধুমাত্র ইরানেই বাংলাদেশের প্রায় ২ হাজারের মতো শ্রমিক রয়েছেন। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে ইরান ছাড়াও ইরাক, ওমান, লেবানন, জর্ডান—এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশেও কর্মসংস্থানের ঝুঁকি বাড়বে। ফলে ব্যাপক হারে কর্মসংস্থান হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে। এতে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সেও বড় ধস নামতে পারে।


বিমান চলাচলে জটিলতা ও ব্যয় বৃদ্ধি

যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশই আকাশপথ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়েছে কিংবা ইরান-ইসরায়েল সীমা এড়িয়ে ফ্লাইট পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছে। এতে যাত্রাপথ দীর্ঘ হচ্ছে এবং বিমানের টিকিটের দামও বাড়ছে। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ মধ্যপ্রাচ্যে যাতায়াত করে থাকেন—বিশেষ করে শ্রমিকরা। ফলে তাদের ভোগান্তি বাড়ছে এবং ভ্রমণ খরচও বেড়ে যাচ্ছে।


বাংলাদেশ-ইরান বাণিজ্যে প্রভাব

ইরানের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সীমিত হলেও তা সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশ মূলত পাটের সুতা, তৈরি পোশাক, প্লাস্টিক ও রাবারজাত পণ্য ইরানে রপ্তানি করে থাকে। অন্যদিকে, ইরান থেকে বাংলাদেশ মসলা ও কার্পেট আমদানি করে।

২০২৪–২৫ অর্থবছরে এই বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৬.১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে রপ্তানি ১৫ মিলিয়ন এবং আমদানি ১.১৭ মিলিয়ন ডলার। যুদ্ধের কারণে এই স্বল্প পরিসরের বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।


বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ ও আমেরিকায় তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে হরমুজ প্রণালী ও সুয়েজ খাল গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ। ইরান যদি হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়, তাহলে বিকল্প পথে পণ্য পাঠাতে হবে, যা ৩০–৩৫% বেশি খরচ করতে হতে পারে। এতে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে, বিশেষ করে পোশাক শিল্পে, নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।


 
ভারতের ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি ও ব্যবসায়িক ক্ষতি

ভারত ইরান ও ইসরায়েল—উভয়ের সঙ্গেই কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ভারত দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনা কমাতে কূটনৈতিক আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। তবে ভারতের বড় একটি সমস্যা হলো, ইরানে তার বিপুল পরিমাণে তেল আমদানি এবং ইসরায়েলে ভারতের অনেক কোম্পানির বিনিয়োগ।ইসরায়েলে ভারতের যে কোম্পানিগুলোর ব্যবসা রয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেঃ টিসিএস, উইপ্রো, ইনফোসিস, আদানি গ্রুপ,  এসবিআই,  সান ফার্মা।

এই কোম্পানিগুলোর অনেকে ইতোমধ্যেই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এবং পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আরও ক্ষতি হবে বা ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হতে পারে।


পাকিস্তান নিরাপত্তা হুমকির মুখে

ইরানের সঙ্গে পাকিস্তানের রয়েছে ৯০৯ কিলোমিটার সীমান্ত। অতীতে এই সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে নানা উত্তেজনা দেখা গেছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ইরান পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে হামলা চালায়, পরদিনই পাকিস্তান পাল্টা হামলা করে। বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান অঞ্চলে নিরাপত্তা হুমকি বেড়েছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই পাকিস্তান বেলুচিস্তান সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে।

এছাড়া, পাকিস্তানে প্রায় ১৫% শিয়া জনগোষ্ঠী রয়েছে। ফলে ইরানের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিলে পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়তে পারে।


বিশেষজ্ঞদের মতামত

সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ মনে করেন, যুদ্ধের ফলে ইরানের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা ও সহযোগিতার ক্ষেত্র সংকুচিত হতে পারে। একই সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গে চীন ও রাশিয়ার সহযোগিতাও কমে যেতে পারে।

ভারতের সাবেক এক্সাইজ ও কাস্টমস বোর্ড চেয়ারম্যান সুমিত দত্ত মজুমদার বলেন, ভারতকে ইরান ও ইসরায়েল—উভয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। ইরান ভারতকে বন্ধুত্বপূর্ণ শর্তে তেল দেয়, যা অর্থনীতির জন্য জরুরি। যুদ্ধের ফলে তেলের দাম বেড়ে গেলে ভারতের জন্য বড় সমস্যা তৈরি হবে।

পাকিস্তানের বিশ্লেষক ইহসানুল্লাহ টিপু মেহসুদ জানান, পাকিস্তানে শিয়া-সুন্নি বিভাজন আগে থেকেই বিদ্যমান। এ অবস্থায় ইরানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।


ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও জনজীবনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে জ্বালানি সংকট, রপ্তানি খাতে ধস, কর্মসংস্থান হ্রাস এবং রাজনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। এ অবস্থায় অঞ্চলভিত্তিক কূটনৈতিক তৎপরতা এবং বিকল্প প্রস্তুতি গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।


নিউজটি আপডেট করেছেন : নিউজ ডেস্ক

নিউজ লিঙ্ক কপি করুনঃ
www.dailyeye.site/details/587/ইরান-ইসরায়েল-যুদ্ধ:-উপমহাদেশে-অর্থনীতি,-নিরাপত্তা-ও-জীবনযাত্রায়-বড়-প্রভাবের-আশঙ্কা/

কমেন্ট বক্স