আবদুল্লাহ আল মামুনঃ
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের সিদ্ধান্ত থেকে সম্পূর্ণরূপে সরে এসেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। শুধু ব্যবহারিকভাবেই নয়, এবার আইন ও বিধিমালার মাধ্যমেও ইভিএমকে নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সংস্থাটি।
ইসি সূত্র জানিয়েছে, ইভিএম বিষয়ক প্রকল্পের কার্যক্রম ২০২3 সালে শেষ হয়। এর পর থেকে আর প্রকল্পটি নবায়ন না করায় তা আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। গত ২১ মে ইভিএম প্রকল্পের পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসানকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
ইসির সহকারী প্রধান খ. ম. আরিফুল ইসলামের স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে জানানো হয়, ২০২৪ সালের ২৯ এপ্রিল প্রকল্প সমাপ্তি প্রতিবেদন (PCR) চূড়ান্তভাবে অনুমোদন পাওয়ার পর ইভিএম প্রকল্প পরিচালককে আনুষ্ঠানিকভাবে অবমুক্ত করা হয়।
নির্বাচনী বিধিমালায় পরিবর্তন: ইভিএম মুছে ফেলার সিদ্ধান্ত
ইসি ইতোমধ্যে ১৩তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনী বিধিমালা সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। গত ২১ মে অনুষ্ঠিত কমিশনের পঞ্চম সভায় ইভিএম সংক্রান্ত সব বিধান বাতিল করার নীতিগত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, “ইভিএম সম্পর্কিত সকল বিষয় আমরা বাতিল করেছি। জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম আর ব্যবহৃত হবে না। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহৃত হবে কি না, তা পরবর্তীতে কমিশনের অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে।” ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ধাপে ধাপে নির্বাচন সম্পর্কিত অন্যান্য আইন ও বিধিমালাতেও ইভিএম সংক্রান্ত অংশগুলো বাতিল করার পরিকল্পনা রয়েছে।
কেন বাদ দেওয়া হলো ইভিএম?
ইভিএম ব্যবহার থেকে সরে আসার মূল কারণ হিসেবে উঠে এসেছে যন্ত্রটির কারিগরি দুর্বলতা, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং রাজনৈতিক ঐকমত্যের ঘাটতি। সাবেক প্রকল্প পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান জানিয়েছেনঃ বর্তমানে ১ লাখ ১০ হাজার মেশিনের মধ্যে অধিকাংশই ব্যবহার অনুপযোগী। শুধু ৪০ হাজারের মতো মেশিন ব্যবহারযোগ্য অবস্থায় আছে। তার মতে, প্রকল্পে দক্ষ কারিগরি জনবল ও সংরক্ষণের উপযুক্ত ব্যবস্থার অভাব ছিল শুরু থেকেই। প্রকল্প মেয়াদ শেষে মেশিনগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দও পাওয়া যায়নি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন স্পষ্ট ভাষায় বলেনঃ “ইভিএম অনেক ঝামেলার বিষয়। আমরা সেই ঝামেলায় যাব না। জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যালট পেপারে করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত।”
- ইভিএমের ইতিহাস: আশাবাদ থেকে ব্যর্থতায়
সূচনা:
এক-এগারো সরকারের সময় ড. এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বে প্রথমবার ইভিএমের ব্যবহার শুরু হয়। বুয়েটের তৈরি এই যন্ত্রের দাম ছিল প্রায় ১২ হাজার টাকা।-
প্রথম ব্যর্থতা:
২০১৫ সালে রাজশাহী সিটি নির্বাচনে একাধিক মেশিন অচল হয়ে পড়ায় বুয়েটের তৈরি মেশিনগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। সেগুলো পরে বাতিল করে উন্নত ইভিএম তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। -
বড় প্রকল্প:
২০১৭ সালে কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন প্রায় ২০ গুণ বেশি দামে ইভিএম কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। বিএমটিএফ থেকে মেশিন প্রতি ২.৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ইভিএম সংগ্রহ করা হয়। পুরো প্রকল্পের ব্যয় ছিল ৩৮২৫ কোটি টাকা। তখন ১.৫ লাখ ইভিএম কেনা হয়। -
ব্যর্থ রক্ষণাবেক্ষণ:
প্রকল্পে মেশিন সংরক্ষণ, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কোনো অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়নি। ফলে ১০ বছরের আয়ু থাকলেও অধিকাংশ ইভিএম ৫ বছরের মধ্যেই অকেজো হয়ে পড়ে। -
ব্যর্থ অর্থায়ন:
২০২৩ সালে ইসি ১২০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত প্রকল্প চেয়েছিল মেরামতের জন্য, কিন্তু বৈশ্বিক অর্থ সংকটের কথা বলে সরকার তা অনুমোদন দেয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “ইভিএম ছিল ত্রুটিপূর্ণ, দুর্বল যন্ত্র। এটি চালাতে রাজনৈতিক ঐক্য ও আস্থা থাকা দরকার, যা ছিল না। রাজনীতিবিদদের মধ্যে ঐকমত্য না থাকলে কোনো প্রযুক্তিই টেকসই হয় না।”