রিপোর্টঃ আবদুল্লাহ আল মামুন
বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি হলো জ্বালানি তেল। এই প্রাকৃতিক সম্পদ কোনো দেশের জিডিপিকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে নিতে পারে, আবার প্রতিপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টির বড় অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের ওপর ‘অতিরিক্ত’ ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়ে আবারও দেখিয়ে দিয়েছেন—জ্বালানি তেল কেবল অর্থনীতিরই নয়, ভূরাজনীতিরও বড় হাতিয়ার।
ট্রাম্প জানিয়েছেন, নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রাশিয়ার কাছ থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি করায় ভারতকে এই শাস্তি পেতে হচ্ছে। একই কারণে চীনকেও শাস্তির হুমকি দিয়েছেন তিনি। ভারতের ওপর শুল্ক কার্যকর হওয়ার আগেই দেশটির শেয়ারবাজার বড় ধসের মুখে পড়ে।
তবে শুধু তেলের মজুত থাকলেই কোনো দেশ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছায় না। কারণ, মজুত থাকা, সেই তেল উত্তোলনের সক্ষমতা, এবং বিশ্ববাজারে বিক্রির সুযোগ পাওয়া—এই তিনটি আলাদা বিষয়। যেমন—ভেনেজুয়েলায় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রমাণিত তেল মজুত আছে, কিন্তু দেশটির অর্থনীতি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সংকটে রয়েছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রেও একই চিত্র—তাদের বিপুল তেলসম্পদ রয়েছে, তবে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এ খাতে প্রভাব ফেলেছে।
চলুন দেখে নেওয়া যাক, ইউএস এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (EIA) তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের শীর্ষ ১০ তেল উত্তোলনকারী দেশ এবং তাদের ভোক্তা অবস্থা—
১. যুক্তরাষ্ট্র
-
উৎপাদন: প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি ১২ লাখ ব্যারেল (বিশ্বের মোট উৎপাদনের ২২%)
-
ভোগ: প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি ব্যারেল (বিশ্বের মোট চাহিদার ২০%)
-
বিশেষ তথ্য: তেল উত্তোলনে শীর্ষে থাকার পাশাপাশি ভোক্তা দেশ হিসেবেও যুক্তরাষ্ট্র এক নম্বরে। দেশটির মজুত নিয়ে ভিন্নমত থাকলেও তা আনুমানিক ৬৯ থেকে ৭৪ বিলিয়ন ব্যারেল।
২. সৌদি আরব
-
উৎপাদন: প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি ১১ লাখ ব্যারেল (১১%)
-
ভোগ: প্রতিদিন প্রায় ৩৬.৫ লাখ ব্যারেল, ভোক্তা তালিকায় ৫ম
-
বিশেষ তথ্য: ওপেকের প্রভাবশালী সদস্য ও বিশ্বের অন্যতম বড় রপ্তানিকারক। অর্থনীতি ব্যাপকভাবে তেল নির্ভর।
৩. রাশিয়া
-
উৎপাদন: প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি ৭ লাখ ব্যারেল (১১%)
-
ভোগ: প্রতিদিন প্রায় ৩৭ লাখ ব্যারেল, ভোক্তা তালিকায় ৪র্থ
-
বিশেষ তথ্য: ইউক্রেন যুদ্ধ ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় রপ্তানি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এশিয়ার বাজারে (বিশেষত চীন ও ভারত) রপ্তানি বাড়ায় উৎপাদনে বড় প্রভাব পড়েনি।
৪. কানাডা
-
উৎপাদন: প্রতিদিন প্রায় ৫৮ লাখ ব্যারেল (৬%)
-
ভোগ: ভোক্তা তালিকায় ৯ম
-
বিশেষ তথ্য: উৎপাদনের ৮৪% আসে আলবার্টা প্রদেশ থেকে। বেশির ভাগ তেল যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়।
৫. চীন
-
উৎপাদন: প্রতিদিন প্রায় ৫৩ লাখ ব্যারেল (৬%)
-
ভোগ: প্রতিদিন ১ কোটি ৫০ লাখ ব্যারেল, ভোক্তা তালিকায় ২য়
-
বিশেষ তথ্য: নিজস্ব উত্তোলন যথেষ্ট হলেও চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় অপরিশোধিত তেল আমদানিকারক। ইউক্রেন যুদ্ধের পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রাশিয়া থেকে তেল আমদানিতে ভারতসহ শীর্ষে।
৬. ইরাক
-
উৎপাদন: প্রতিদিন প্রায় ৪৪.২ লাখ ব্যারেল (৪%)
-
ভোগ: অভ্যন্তরীণ চাহিদা কম, প্রায় ৮০% রপ্তানি করে
-
বিশেষ তথ্য: ২০২৯ সালের মধ্যে দৈনিক উত্তোলন ৬০ লাখ ব্যারেলে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
৭. ব্রাজিল
-
উৎপাদন: প্রতিদিন প্রায় ৪৩ লাখ ব্যারেল (৪%)
-
ভোগ: প্রতিদিন প্রায় ৩০ লাখ ব্যারেল, ভোক্তা তালিকায় ৭ম
-
বিশেষ তথ্য: বিশ্বের গভীরতম তেলক্ষেত্র এখানেই, বেশির ভাগ তেল আসে সমুদ্রতলদেশীয় খনি থেকে।
৮. সংযুক্ত আরব আমিরাত
-
উৎপাদন: প্রতিদিন প্রায় ৪১ লাখ ব্যারেল (৪%)
-
ভোগ: ভেতরেই একাংশ ব্যবহার, প্রায় ৬৬% রপ্তানি
-
বিশেষ তথ্য: তেলের ৯৬% আসে আবুধাবি থেকে। রাষ্ট্রায়ত্ত ADNOC দেশটির শীর্ষ তেল-গ্যাস কোম্পানি।
৯. ইরান
-
উৎপাদন: প্রতিদিন প্রায় ৪০ লাখ ব্যারেল (৪%)
-
ভোগ: প্রায় ৪৩% ভেতরেই ব্যবহৃত হয়, বাকি রপ্তানি
-
বিশেষ তথ্য: ওপেকের বড় সদস্যদের মধ্যে একটি। প্রায় ১৫,৭০০ কোটি ব্যারেল প্রমাণিত মজুত রয়েছে, যা বিশ্বের মোট মজুতের ১২%।
১০. কুয়েত
-
উৎপাদন: প্রতিদিন প্রায় ২৯ লাখ ব্যারেল (৩%)
-
ভোগ: প্রায় ২৯% ভেতরে, বাকি রপ্তানি
-
বিশেষ তথ্য: উত্তোলনের ৭১% রপ্তানি হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তেল ও গ্যাস খাতে বড় বিনিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াচ্ছে।